দঙ্গল ছবিটি যাদের দেখা উচিত

Encrypting your link and protect the link from viruses, malware, thief, etc! Made your link safe to visit.

দঙ্গল ভারতীয় চলচ্চিত্র অভিনেতা আমির খানের নতুন ছবির নাম। এর কেন্দ্রে রয়েছে ভারতীয় কুস্তিগির মহাবীর সিং ফোগাটের জীবনকাহিনি। মহাবীর জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন কিন্তু দেশের জন্য কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক জিততে পারেননি, এই আক্ষেপ থেকে নিজের দুই মেয়েকে কুস্তির প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের হাত দিয়ে সোনা জিতে নেন। কীভাবে এই অসম্ভব সম্ভব হলো, দঙ্গল-এ রয়েছে সেই গল্প। তবে সে কথায় যাওয়ার আগে আমি আপনাদের এ বছরের ২২ জানুয়ারি নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের দিকে নজর দিতে অনুরোধ করব।
হেফাজতে ইসলাম নামের একটি ধর্মীয় সংগঠনের পীড়াপীড়িতে বাংলাদেশের স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে কিছু কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে, প্রতিবেদনের মূল বিষয় সেটি। তার পুনরাবৃত্তি করব না, এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে, এই পত্রিকায় আমিও লিখেছি। আমার আগ্রহ এই প্রতিবেদনের নিচের অংশে:
মাদ্রাসার নেতারা শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে লিখিত আবেদনে অনুরোধ করেন যেন (মাদ্রাসায় ব্যবহৃত স্কুল পাঠ্যগ্রন্থে) হিন্দু, খ্রিষ্টান বা অন্যান্য বিদেশি নাম পরিবর্তন করে ‘অপূর্ব ইসলামিক নামসমূহ’ রাখা হয়। ‘এটা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী বাংলাদেশিদের সুনির্দিষ্ট অধিকার।’ তাঁরা আরও অনুরোধ করেন, ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে কোনো কথাবার্তা যেন বাদ দেওয়া হয়। কারণ, ‘অকারণে কোনো অল্প বয়স্ক মেয়ের সঙ্গে কথা বলা মহাপাপ।’
হেফাজতের নেতারা আরও একটি অনুরোধ জানান। এই দলের একজন মুখপাত্র ফয়েজউল্লাহ বলেন, ‘তাঁর দল চায় শরীরচর্চাবিষয়ক পাঠ্যপুস্তকে যেন মেয়ে বা নারীদের শরীরচর্চার কোনো দৃশ্য চিত্রায়িত না হয়। ছেলেরা যা পারে, মেয়েরা তা পারে না। আমি গাছে চড়তে পারি, কিন্তু আমার স্ত্রী বা ভগিনী গাছে চড়তে পারে না। (সে জন্য) মেয়েরা শরীরচর্চা করছে, এমন চিত্র (পাঠ্যপুস্তকে) অন্তর্ভুক্ত করার কোনো প্রয়োজন নেই।’
পুরো প্রতিবেদনটি পড়া যাবে ইন্টারনেটে এই লিঙ্ক ব্যবহার করে: http://nyti.ms/2kgzLno
এবার দঙ্গল ও মহাবীরের কথায় আসি। এই ভারতীয় কুস্তিগিরের স্বপ্ন ছিল আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সোনার মেডেল ছিনিয়ে আনা। নিজে পারেননি, তিনি ভাবলেন সে কাজ করবে তাঁর ছেলে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, পরপর তাঁর চারটি সন্তানের জন্ম হলো, চারজনই মেয়ে। হতাশ হয়েছিলেন মহাবীর, কিন্তু যে মুহূর্তে বুঝতে পারলেন মেয়েদের ধমনিতে বইছে কুস্তিগিরের রক্ত, ঠিক করলেন তাঁদের প্রশিক্ষিত করবেন। স্ত্রী আপত্তি করে, পাড়া-প্রতিবেশী আপত্তি করে, স্কুলের সহপাঠীরা পরিহাস করে। সব বাধা অগ্রাহ্য করে মহাবীর তাঁর জ্যেষ্ঠ দুই মেয়েকে কুস্তি লড়তে প্রস্তুত করে তোলেন। শুধু প্রস্তুতই নয়, তাঁদের হাত দিয়েই ছিনিয়ে আনেন সোনার পদক।
এটা কোনো কল্পকাহিনি নয়, বাস্তব ঘটনা। মহাবীরের দুই মেয়ে—গীতা ও ববিতা এ পর্যন্ত ভারতের জন্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রায় ৩০টির মতো পদক জিতেছেন। ২০১০ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ গেমসে গীতা ফাইনালে ওঠার পর তাঁর নিজের মনেই সন্দেহ জাগে সোনা জেতা তাঁর পক্ষে সম্ভব কি না। মহাবীর তখন তাঁকে বলেন, ‘মনে রাখবে, এই সোনা একা তোমার জন্য নয়। হাজার হাজার মেয়ে, যাদের সম্ভাবনা নিয়ে পরিহাস করা হয়েছে, সেই সোনা হবে তাদের জন্য। সবাই তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।’
যাঁরা মেয়েদের শক্তি–সামর্থ্য বা নারীদের শরীরচর্চার বিরোধী অথবা এই মানসিকতা ধারণ করেন, তঁারা ছবিটি দেখতে পারেন। একটু সমর্থন পেলে মেয়েরা কী অসম্ভব সাধন করতে পারে, এ সহজ কথাটি তাঁরা হয়তো বুঝতে পারবেন। বুঝতে পারবেন, মেয়েরা শুধু গাছে চড়া নয়, কুস্তি লড়ে ছেলেদের কুপোকাত করতেও সক্ষম। এ জন্য চাই তাঁদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি। বাবা হিসেবে, অভিভাবক হিসেবে তাঁরা যদি ধরেই নেন তাঁদের কন্যাসন্তানদের হেঁশেলে হাঁড়ি ঠেলা ও সন্তানের জননী হওয়া ছাড়া অন্য কোনো কাজ করার ক্ষমতা নেই, তাহলে সে সুযোগ সৃষ্টি হবে কী করে?
ধর্মের দোহাই দিয়ে মেয়েদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ মানবসভ্যতার মতো পুরোনো। কনফুসিয়াস মন্তব্য করেছিলেন, এক হাজারটা মেয়েও একটা ছেলের সমতুল্য নয়। কিন্তু তারা যে শুধু সমতুল্য তা-ই নয়, অনেক সময় ছেলেদের চেয়ে বহু গুণে ভালো হওয়ার ক্ষমতা রাখে, গত পাঁচ হাজার বছর মেয়েরা নানাভাবে সে পরীক্ষা দিয়েছে। সে পরীক্ষায় তারা পাসও করেছে। আমাদের কনফুসিয়াস বা ক্লিওপেট্রার জমানায় ফিরে যাওয়ার দরকার নেই, আধুনিক সময়ের কথা ধরুন। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই শিক্ষার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এগিয়ে। আগে মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ ছিল না, ছেলেরা কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই শিক্ষার দৌড়ে অংশ নিয়েছে। এখন অবস্থা বদলেছে, মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ বেড়েছে, সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে তাদের সাফল্য। কিছু উদাহরণ দিই।
দুই বছর আগে শিল্পোন্নত পশ্চিমা দেশগুলোর সংস্থা ওইসিডি কয়েক হাজার ছেলেমেয়ের পরীক্ষার ফলাফল বিচার করার পর এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে, বিজ্ঞান বা অঙ্কে মেয়েরা এখনো পিছিয়ে থাকলেও মোটের ওপর সব বিষয়ে তারা ছেলেদের চেয়ে বহু গুণে এগিয়ে। অঙ্ক, বিজ্ঞান ও পাঠ—এই তিন বিষয়ে গড় হিসাবে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রায় ৫০ শতাংশ। এই ব্যবধানের কারণ কী? ওইসিডির সমীক্ষকেরা বলছেন, ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা পাঠে অধিক সময় ব্যয় করে, হোম ওয়ার্কে অধিক মনোযোগী এবং ছেলেরা অধ্যয়নের বদলে অন্য কিছু—যেমন খেলাধুলা বা ফুর্তি করাকে অধিক গুরুত্ব দেয়। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার দুই গবেষক অধ্যাপক লেস্টর লুশার ও ভাসিলি ইয়েসেনভ আরও একটি কারণ নির্দেশ করেছেন। ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা অনেক সকালে ঘুম থেকে ওঠে। তাঁদের ব্যাখ্যা, মেয়েদের শারীরিক গঠন এমন যে তারা অনেক ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়ে। অন্য কথায়, গঠনগতভাবেই মেয়েরা লেখাপড়ায় ভালো করার জন্য তৈরি। স্কুল পর্যায়ে মেয়েদের এই ভালো করাটা এখন বাংলাদেশের বেলায়ও খাটে। গত কয়েক বছরের এসএসসি পর্যায়ের ফলাফল দেখলেই কথাটা প্রমাণিত হবে। মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ বেড়েছে, সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণও তারা রাখছে।
সুযোগ পেলে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা যে অনেক ভালো করতে সক্ষম, গাছে চড়া থেকে হিমালয়ে ওঠা পর্যন্ত তার আরও কিছু প্রমাণ দিই। লন্ডনের দ্য ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকা জানিয়েছে, গত বছর যুক্তরাজ্যে ছেলেদের চেয়ে প্রায় এক লাখ বেশিসংখ্যক মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য আবেদন করেছে। আর আমেরিকায় এখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যত ছাত্রছাত্রী পাস করে বেরোচ্ছে, তার ৫৭ শতাংশই মেয়ে। যুক্তরাজ্যের সাটন ট্রাস্ট নামের একটি সংস্থা দেশজুড়ে সমীক্ষার পর জানতে পেরেছে, স্কুলের শেষ বর্ষে পা দেওয়ার আগেই ৬৫ শতাংশ মেয়ে ঠিক করে নেয় তারা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাবে। একই পর্যায়ের ৫৮ শতাংশ ছেলে সেই সিদ্ধান্তের পক্ষে। সেভ দ্য চিলড্রেন পরিচালিত আরেক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা অনেক দক্ষ। ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের এই তারতম্য (জেন্ডার গ্যাপ) ক্রমেই এত প্রকট হয়ে উঠছে যে সেভ দ্য চিলড্রেন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আশু প্রতিকারের ব্যবস্থা না নিলে ছেলেদের পিছিয়ে পড়া স্থায়ী আকার নেবে।
হিমালয়ে ওঠার যে কথাটা বললাম, তা–ও কেবল কথার কথা নয়। গত সপ্তাহে অংশু জামসেনপা নামের ভারতের এক মেয়ে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে দুবার এভারেস্ট শৃঙ্গ জয় করেছেন। কোনো পুরুষ এমন সাফল্য অর্জন করেননি। দুই বছর আগে অরুনিমা সিংহ নামের ২৬ বছরের এক মেয়ে, যাঁর এক পা নেই, তিনিও হিমালয় জয় করেছেন। বাংলাদেশেরও একাধিক নারী এভারেস্ট জয় করে ফিরেছেন। আর হ্যাঁ, ইসলামি রাষ্ট্র ইরানেরও দুজন মেয়ে এভারেস্ট জয় করে ফিরেছেন। তাঁদের একজন ফারখনদেহ্ সাদেগ, তিনি একজন গ্রাফিক ডিজাইনার। অন্যজন লোলেহ্ কেশাভার্জ একজন ডেন্টিস্ট।
আরেকটি খবর দিই। সারা পৃথিবীতে, এমনকি আমাদের বাংলাদেশেও ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা বাঁচে বেশি দিন। তাদের স্মৃতিশক্তিও ছেলেদের চেয়ে বেশি। মার্কিন গবেষকেরা বলেছেন, মস্তিষ্কের দক্ষতা বা কগনিটিভ স্কিলের প্রতিটি ক্ষেত্রেই মেয়েদের শারীরিক গঠন এমন যে তারা ছেলেদের টপকে যেতে সক্ষম। নেতা হিসেবেও ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা অধিক সক্ষম। এর একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও রয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব বাফালোর একদল বিজ্ঞানী হাজার হাজার নারী-পুরুষের কর্মক্ষমতা নিরীক্ষণের পর এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, মেয়েরা তাদের শরীরের এস্ট্রোজেন উপাদানের জন্য ধকল বা স্ট্রেস সহ্য করতে পারে অনেক বেশি। একই কারণে মেয়েরা একসঙ্গে একাধিক কাজ করতে সক্ষম। এ কথা অবশ্য আমরা সবাই জানি, কারণ আমাদের সবার মায়েরাই অহোরাত্র একই সঙ্গে কত কাজ করেন, সে তো আমরা সবাই জানি।
সুযোগ পেলে মেয়েরা পারে না, এমন কোনো কাজ নেই। কেউ কেউ চায় না মেয়েরা লেখাপড়া করুক, বাইরে বেরিয়ে আসুক, স্বাধীন হোক। এত দিন মেয়েদের ঘরের আসবাব ভেবে আসা হয়েছে, চাইলে কিনে আনা যায়, চাইলে ছুড়ে ফেলা যায়। যখন যা বলা হয়েছে, তারা তা-ই করেছে। লেখাপড়া শিখলে, স্বাধীন হওয়ার সুযোগ পেলে তেমন ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ তো কমে আসবে, তাই না?
অথচ সুযোগ পেলে আমাদের মেয়েরা কী অবাক সব অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে, দঙ্গল ছবিটি তার প্রমাণ।
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।

Comment

Post a Comment